তাই হয়তো গুণে গুণে ঠিক একমাস পড়েই তার বাসায় সবস জানাজানি হয়ে গেলো। তার বড় ভাই তাকে অনেক মেরে তার হাতের ফোন ভেঙে ফেলে। তার ভাগ্নি অথৈ থেকে জেনেছিলাম আমি। এরপরও সে অলওয়েজ বাসার সামনে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতো আমাকে দেখতে। স্কুলে যাওয়া আসার সময় আমি ও তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু সামনাসামনি কথা বলার সাহস ছিলো না আমাদের কারোই। দুর থেকেই দু'জন দুজনকে অসম্ভব ভালোবাসতাম। এভাবে দুই মাস কেটে গেলো। আমরা কথা বলি না,শুধু চোখে চোখে যেইটুকু কথা হতো সেইটুকুই। দু'জন দুজনের চোখের ভাষা বুঝতাম আমরা। তাই কেউ কখনো কাউকে ভুল বুঝিনি। সে আমাকে আমার ভালোবাসা কে সম্মান করতো। আর আমিও তাকে অসম্ভব সম্মান করতাম। এরপর শুরু হলো প্রতিবেশীদের অত্যাচার। আমি নাকি খারাপ মেয়ে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে থাকি, প্রেম করি হাবিজাবি অনেক কিছু। মোট কথা অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলাম প্রতিবেশীদের অত্যাচারে। আমি সাদাফ ভাইয়ের সাথে কখনো আলাদা করে দেখাই করি নি অথচ। তারা পাড়ায় ছড়িয়েছে যে আমি নাকি সাদাফ ভাইয়ের সাথে ঘুরতে গিয়েছি। আমি হাজারো চেষ্টা করে ও বুঝাতে পারি নাই যে আমি বা সাদাফ কেউ ই আলাদা দেখা করার কথা ও ভাবি নি কখনো। শেষ পর্যায়ে আমার অবস্থা এমন হয়েছে যে আমি খাওয়া দাওয়া, ঘুম সব বন্ধ করে শুধু করে কাঁদতাম। বাসার বাহিরে যাওয়া ও বন্ধ করে দিলাম। একটানা ৫ দিন বাসার মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ করে রাখলাম। সেদিন রাত ১২ টা বাজে ঘুম ভাঙতেই মুঠো ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি একটা আননোন নাম্বার থেকে টেক্সট এসেছে। টেক্সট ওপেন করতেই দেখলাম,
ঐ পিচ্চি কি হয়েছে তোমার? আমার চিন্তা হচ্ছে ভীষণ। তুমি কি অসুস্থ? প্লিজ অসুস্থ হও আর যাই হও নিজের কোনো ক্ষতি করো না। প্লিজ, মরে যাবো আমি।ভালোবাসি পাখি ❤️
আমি ফোন টা রেখে অজু করে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে নিলাম।সাথে দু’রাকাআত নফল নামাজ ও পরলাম। এরপরে ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হলাম বাসা থেকে। পুরো রাস্তা খুঁজে ও তাকে কোথাও পেলাম না। নিমিষেই মন টা আবারও খারাপ হয়ে গেলো। স্কুল থেকে আসার সময় ও তাকে কোথাও পেলাম না। এভাবে দুই দিন তাকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। অবশেষে শুক্রবার সকাল ১০ টায় আমি তাকে কল করলাম। কল রিং হতেই ওপাশ থেকে একটা মহিলা কন্ঠ ভেসে আসলো।মহিলা কন্ঠ শুনে আমি মনে করেছি তার ভাবি কল ধরেছে। তাই কল কেটে দেই। যেই আননোন নাম্বার থেকে টেক্সট এসেছিলো সেই আননোন নাম্বারে বিকেলে কল দিলাম। কল রিসিভ হলো না বরং বেজে বেজে কেটে গেলো। ফোন রেখে দিয়ে সবার জন্য রাতের খাবার রান্না করলাম। রান্না শেষ করে রুমে এসে শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। রাত ৮ টায় ঐ আননোন নাম্বারে আবারও কল দিলাম। এবার কল রিসিভ হলো। শান্ত একটা কন্ঠে কেউ একজন সালাম দিলো। আমি সালাম শুনেই বুঝে গেলাম এটা সাদাফ ভাইয়ের নাম্বার। এতো দিন পর প্রিয় মানুষটার কন্ঠস্বর শুনে কষ্ট গুলো যেনো বাঁধ মানতে চাইছে না।কেঁদে দিলাম। সে চুপ করে সবটা শুনছে। এভাবে ৩/৪ মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর সে আদুরে কন্ঠে আমায় ডাকলো,
আইশু
আমি নিশ্চুপ কেঁদেই যাচ্ছি।
সে আবার বললো, এবার কিন্তু আমি কেঁদে দিবো। প্লিজ শান্ত হও।কাঁদছ কেন এভাবে?? কেউ কিছু বলছে??
আমি কান্না থামিয়ে বললাম, না।
সাদাফঃতাহলে?
আমি ফুপিয়ে বললাম, আগে বলুন কেমন আছেন?
ভালো তবে মন খারাপ ভীষণ কতদিন দেখি না তোমাকে।
হুম, কিন্তু আপনি আমাকে ভুলে গেছেন। কত খুঁজছি দু'দিন ধরে। আপনি কোথায় হারিয়ে গেলেন?? বলেই আবার কেঁদে উঠলাম।
সে শান্ত কন্ঠে জবাব দিল, ভাইয়ার সাথে ভাবির গ্রামে গিয়েছিলাম আজকে বিকেলে তুমি যখন কল দিয়েছো তখনই বাসায় আসছি। সাথে ভাইয়া ছিল তাই কল ধরি নি। সরি পাখি।
হুম, কিন্তু আমি ও সরি। একটা ভুল করে ফেলেছি।
কি করেছো??
আপনার আগের নম্বরে কল দিয়েছিলাম মনে হয় আপনার ভাবি ধরেছে।
না মা ধরেছে প্রবলেম নাই। কিছুই হবে না। আর ঐ নম্বরে আর কল দিও না।
ওকে। ভুলে গিয়েছেন আমায়??
মরে যাবো তাও তোমাকে ভুলতে পারবো না। প্লিজ এ কথা বলো না। কষ্ট হয় আমার।
হুম আমার ও।(ঠোঁট উল্টে)
ভালোবাসি পাখি। অনেক বেশি ই ভালোবাসি।
আমিও বাসি।কিন্তু আমি খুব খারাপ। আপনাকে কষ্ট দেই। আমার জন্য আপনার ভাইয়া আপনাকে মারে??।
তোমার জন্য মরে যেতেও রাজী। আর এটা তো সামান্য।
একদম চুপ আর একটা কথা বললে একদম মেরে ফেলবো আপনাকে।
এভাবে কথা বলে ফোন রাখলাম। সবার আড়ালে সপ্তাহে একদিন কথা বলি ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে। দিনগুলো ভালোই কাটছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন আমি কোচিং এ থাকাকালীন সময়ে সাদাফ কল দিলো ভাবি কল ধরলে সে কেটে দেয়।ভাবি আমার ছোট বোন কে জিজ্ঞেস করলো এটা কার নাম? ও সাদাফ আর আমার সবকিছু বলে দেয় ভাবিকে।ভাবি বাসার সবাইকে বলে দেয়। আব্বু ভাইয়া সবাইকে। আমি বাসায় ফেরার সাথে সাথেই ভাইয়া আমাকে অনেক বকে প্লাস জুতো দিয়ে ঢিল ছুড়ে। আব্বু এসে ও অনেক কথা শুনায়।আর আব্বু অনেক টা কষ্ট ও পায়।কারণ আব্বু আমার থেকে এটা একেবারেই আশা করে নি।আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে আব্বুর জন্য। আমি রুমে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙতে ঘড়িতে দেখি রাত নয়টা বাজে। আমি কিছু না ভেবেই তার ফোনে কল করলাম। একবার দুবার রিং হতেই ওপাশ থেকে কোনো এক পুরুষ কন্ঠ শুনতে পেলাম। বুঝলাম এটা সাদাফ না।তাই কল কেটে দিলাম। কিন্তু বিপদ যা হবার তা তো হয়ে গিয়েছে অলরেডি। একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসলো।আমি কল রিসিভ করে সালাম দিতেই ওপাশ থেকে একটা পুরুষ কন্ঠ শুনতে পেলাম। বুঝলাম এটা সেই ব্যাক্তি যে ওর ফোনে আমার কল রিসিভ করেছিলো। কিছু না বলেই ফোন কেটে দিলাম। সেদিন আর ঘুম হয় নাই। সারা রাত অনেক চিন্তা হলো।পরদিন ক্লাসে যেতেই বান্ধবীর সাথে শেয়ার করি সবটা। স্কুল থেকে বাসায় আসার পথে দেখলাম তাকে।কেমন মন মরা লাগছে তাকে। ইচ্ছে করছে ছোটে গিয়ে জিজ্ঞেস করি তাকে কিন্তু এটা সম্ভব না। বাসায় যাওয়ার খানিক পরেই বান্ধবী রিয়া আসলো। ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিল। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। ও বলতে শুরু করলো,
আয়েশা সাদাফ ভাইয়ের বাসায় অনেক প্রবলেম হইছে। কাল রাতে উনার ভাইয়া উনাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে অনেক মেরেছে। হাত পায়ে দাগ হয়ে বসে গেছে।
কথা টা শুনে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। হাত পা কেমন অবস হয়ে আসছে। কথা বলার শক্তি টুকু ও আর নেই মনে হচ্ছে।
?
১৫ দিন পর সাদাফ কল দিয়েছে আজ। কল রিসিভ করে সালাম দিলাম। কিন্তু কোন জবাব এলো না শুধু কান্নার শব্দ আসছে। হুম, সাদাফ কাঁদছে। এই প্রথম কাঁদছে সে।তার কান্না শুনে আমার ভেতর টাও পুড়ছে। ৫ মিনিট ধরে সে কেঁদেই যাচ্ছে। আমি এবার তাকে ডেকে উঠলাম সে সারা দিলো না। আমি আবার ও ডাকলাম। সে কান্না থামিয়ে ফুপিয়ে বললো, আমাদের ভাগ্য টা এমন কেন আইশু?? কেন এতো কষ্ট আমাদের?? সেদিন দু'জন কথা বলে ঠিক করলাম যে আমরা সবসময় কথা বলবো না ১৫ দিন বা মাসে একবার দুবার কথা বলবো। যেন ধরা না পরে যাই সেই জন্য। এভাবে কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর আবারও ওর বাসায় জেনে গেলো ওর বড় ভাই। দোষ টা ওর ই ও বিশ্বাস করে ওর ভাবি কে সব শেয়ার করতো। ওর ভাবি বলতো ওর ভাইকে।আর ভাইয়া তা শুনে ওকে অনেক মারতো। সবসময় মেয়েদের বাসায় বেশি প্রবলেম হলেও আমাদের ক্ষেত্রে সাদাফের বাসাতেই বেশি প্রবলেম হতো। সব রকম প্রবলেম কে সাথে নিয়ই চলছিলাম। এতোকিছুর পরেও নিজরা অন্নেক টা ভালো ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন কল দিয়ে বললো, তার ভাবি আমার সাথে কথা বলতে চায়।আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ভাবির হাতে ও ফোন টা ধরিয়ে দেয়।আমি মানষিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম না তার সাথে কথা বলার জন্য। তাই হয়তো হতভম্বের মতো সালাম টাও দিলাম না ভাবি কে।আর ভাবি ও হয়তো আমাকে অভদ্র মনে করেছে। ভাবি আমাকে সালাম দেয়।আমি সানামের জবাব দিতেই ভাবি বলতে শুরু করলেন,
শুনো তোমরা যেই রিলেশনশিপে আছো এটা কখনো হবার নয়।আমার শশুর এটা কখনো মেনে নিবে না।এমনকি সাদফের ভাইয়াও মেনে নিবে না এই সম্পর্ক টা।আর কখনো ফোন দিও না। এই কথা গুলো সাদাফই তোমাকে বলতে চাছিলো। কিন্তু ও বললে নাকি তুমি কষ্ট পাবে। তাই আমাকে দিয়ে বলাচ্ছে। এইটুকু বলেই উনি সাদাফকে ফোন টা ধরিয়ে দিলেন।
আমি কি শুনছি বুঝতে পারছি না। আমার কানে যেনো কথা গুলো লোডিং হতে চাইছে না। এবার সাদাফ বলতে শুরু করলো,
হুম, আর কখনো কল দিও না আর মাফ করে দিও আমাকে।আর কিছু বলবা তুমি??
আমি কথা বলার মতো পরিস্থিতিতে ছিলাম না তাই চুপ করে ছিলাম।সাদাফ বার কয়েক আমার নাম ধরে ডাকলো।এরপর আমি মুখ খোললাম,
না কিছু বলার নাই। তবে শুধু দোয়া করি... আল্লাহ আপনার ভাগ্যে এমন কাউকে যেন পাঠায়, সে যেন আপনাকে অনেক হেপি রাখতে পারে। আমি না হয় কষ্টই দিলাম ভালো থাকবেন। বলেই কল কাটলাম।
সারারাত কেঁদে নিজের ভাগ্য মেনে নিয়ে সকালে বাসা থেকে বের হলাম। সামনে তাকে দেখেও না দেখার ভান করে মাথা নুইয়ে চলে গেলাম। স্কুল থেকে আসার সময় ও তার দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে চলে আসলাম। অনেক চেষ্টা করে ও পারিনি তাকে ভুলে যেতে। তাই বান্ধবী রিয়া কে বললাম আমাকে এমন কিছু এনে দিতে। যা খেয়ে মরে যেতে পারবো। অনেক জোর করার পরও রিয়া রাজি হলো না। অবশেষে আমার জেদ এতো পরিমাণ বেড়ে গেলো যে আমি বাসায় থাকা অনেক গুলো নাপা এক্সট্রা একসাথে খেয়ে নিলাম। ঠিক পনেরো মিনিট পরই ঔষধ রিয়াকশন শুরু হলো। বমি হচ্ছে তো হচ্ছেই টানা দু'ঘন্টা তেও থামার নাম নাই। বাসার সবাই মিলে হসপিটালে নিয়ে গেলো।ডক্টর চেক-আপ করে বললেন গ্যাস্টিক প্রবলেম। আমি মনে মনে বেচে গেলাম। ডাক্তার কিছু বুঝতে পারে নি তাই। ডক্টর বমির স্যালাইন দিলো। তা খেয়েও বমি কমার নাম নেই। তারপর কেউ এসে টক খাওয়ালো। এতে করে বমি একটু কমেছে ঠিকই কিন্তু ঘুম আসছে না একটু ও। নামাজ পড়ে কান্না করে আল্লাহর কাছে কত যে প্রার্থনা করেছি চোখ দুটোতে একটু ঘুম দেওয়ার জন্য। তার হিসেব ছাড়া। কিন্তু আল্লাহ ও সহায় হলেন না আমার উপর। সারাটা রাত শুধু তাকিয়ে ছিলাম। চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরেছে। আমার মাথার কাছে আব্বু ও সারা রাত না ঘুমিয়ে বসে ছিলেন। আমার চোখের পানি দেখে এই মানুষ টার ভেতর টাও যেন ব্যাথায় পুড়ে যাচ্ছে। ফজরের আজান পড়তেই আব্বু উঠে নামাজ পড়তে গেলেন।নামাজ শেষ করে নাস্তা বানিয়ে নিয়ে আসলেন। জোর করেই একটু খাইয়ে দিয়ে আব্বু চলে গেলেন। এই মানুষটার কষ্ট দেখে আমি নিজের কষ্ট ভুলে গেলাম। নাহ! আমার মরে গেলে চলবে না।আব্বুর জন্য হলেও আমাকে বেচে থাকতে হবে।