ঘরে ফিরে স্ত্রীকে না দেখে বিস্মিত হয় বিভান।নিচে ও পায়নি। হয়ত মায়ের রুমে আছে।আজ একটু জলদি ফিরেছে বিভান। কাজের চাপ অতো ছিলোনা সেজন্যই।দিল্লিতে জন্ম বিভানের।একজন ভারতীয় নাগরিক আর সফল ব্যাবসায়ী।বেশ নাম ডাক ও আছে ওর।শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বেলার অপেক্ষা করছে বিভান হঠাৎ চোখ পড়লো বেলার ফোনে।সেখানে ভিডিও কল উঠে আছে। আগেই বিশটার মতো এসেছিলো।বিভান নম্বর চেক করে দেখলো কল আসছে বাংলাদেশ থেকে।একটু হেসে নেয় পরক্ষনে ভাবলো বেলা কই?এতক্ষন যাবৎ কল আসছে ও ধরেনি তারমানে অনেকসময় পর্যন্ত রুমে নেই ও।বিভান ওয়াশরুমে চলে যায়।ভেবেছে হয়ত বেলা চলে আসবে।কিন্তু পনেরমিনিট গেলো বেলা ফেরেনি।বেলার ফোনটা হাতে নিয়ে বিভান রুম থেকে বেরিয়ে আসে।নিচে এসে এঘর ওঘর খুঁজতে থাকে।কাজের লোকগুলো ওকে দেখে সরে গেছে।অনেকটা সময় পর্যন্ত বেলাকে না পেয়ে বেলার কাজের মেয়ের রনীতা কে জিজ্ঞেস করে,
''ম্যাম কই?"
''ম্যাম ছাদে গেছে।মরিচ বাটে।"
''হোয়াট?"
বিভান রেগে দৌড়ে ছাদে চলে আসে।বেলা ওরদিকে পিঠ দিয়ে বসে মরিচ বাটছে।বিভান ওর পিছে এসে দাঁড়ায়।বেলার চোখজোড়া বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়াচ্ছে।মেয়েটার পিঠে সমস্যা।এভাবে বসে থাকতে পারেনা।ওর পিঠের এমন দুটো হাড় অকেজো যেগুলো বাবু ধারন করতে সাহায্য করে।ডাক্তার ওদের বলেছিলো এমন কোন কাজ বেলা যেন না করে।নাহলে ওদের বাবা মা হওয়ার পসিবিলিটি শেষ হয়ে যাবে। রেগে চিৎকার করে উঠে বিভান। ও বলল,
''কি করছো এগুলো?"
বেলার হাত থেমে যায়।কেঁপে উঠে ও।লোকটা এসময়ে বাসায় কেন?বেলা বলল,
''আপনি চলে এসেছেন?এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে?"
''বেলা আমার প্রশ্নের উত্তর এটা নয়।তুমি কেন করছো এগুলো।ডাক্তার মানা করেছিলো তোমাকে।"
''বেশি না তো।হয়ে গেছে আমার। একটু অপেক্ষা করুন।"
বিভান ওর দু কাঁধ ধরে বলল,
''তুমি এগুলো করছোনা আর।ব্লেন্ডারে বাটা হবে এই সব গুলো। "
''কি যে করেননা।হয়ে গেছে যান প্লিজ।"
কথাটা বলেই চোখের ওপর থেকে চুল সরাতে গিয়ে মরিচ ওয়ালা হাত চোখে লেগে যায় ওর।দুচোখ বুজে চিৎকার করে বলতে শুরু করলো,
''পানি পানি!!জ্বলে যাচ্ছে!!!
''ইরেসপনসিবল কেমনে হও এতো?"
রেগে বেলা কে কোলে তুলে নেয় বিভান।ওদের দেখে কাজের লোকগুলো কানাকানি করতে থাকে।ড্রয়িংরুম পাস করার সময় বিভান কাজের লোক গুলো কে বলল,
''ছাদের বাকি মরিচগুলো ব্লেন্ডারে পিষে দে।"
বেলাকে রুমে এনে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দেয় বিভান।তারপর জোরে জোরে পানি ঝাপটা দিতে থাকে বেলার চোখে।এবার একটু স্বাভাবিক হলো বেলার চোখ তারপর ও খুলতে পারছেনা।বিভান গেঞ্জীর এককোনা মুখে ঢুকিয়ে গেঞ্জীটা একটু গরম করে বেলার চোখে চেঁপে ধরে।বেলার চোখ একদম লাল হয়ে গেছে।বিভান চোখে ফুঁ দিয়ে বলল,
''জ্বলছে?"
বেলা মাথা নেড়ে বলল,
''না।"
বেলাকে নিয়ে খাটে বসালো বিভান।তারপর মুখটা মুছে দিয়ে আবার রাগান্বীত কন্ঠে বেশ জোরেই বলল,
''বাসায় আবার মরিচ বাটা কবে থেকে খাচ্ছে?"
''আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো ইলিশ মাছ বাটা মরিচ দিয়ে ভুনা করে খেতে।"
বিভান রেগে বলল,
''এগুলো তোমার কাজ?এতো গুলো কাজের লোক থাকতে কেন করতে গেলে?"
''ওদের চুল পড়ে।"
''উফ তুমি আর তোমার কথা বার্তা।ভালো একটা কাপড় পরে নাও।"
বেলা হেসে বলল,
''কেন?কোথাও যাবেন?"
''যাচ্ছো নাকি পরিয়ে দেবো।"
''যাচ্ছি আমি।"
হালকা পিংক কালারের একটা শাড়ী পরে আসে বেলা।চুল গুলো কে খোপায় গুঁজে নিয়েছে ও।কপাল বরবার কালো ছোট্ট একটা টিপ।বিভান বলল,
''এখন লাগছে আমার বৌ।একটু আগে তোমাদের ভাষায় কি যেন বলো কাজের বেটি জরিনা লাগছিলো।"
বেলা হেসে বলল,
''লাগতেই হবে আমি শেখ বাড়ির বৌ।"
আঁচল কোমড়ে গুঁজে দিলো বেলা।বিভান বলল,
''বৌ হতে গিয়ে পিঠের কথা ভুলে গেছো।তোমার বাসা থেকে কল এসেছিলো।"
বেলার মুখ একদম মলিন হয়ে গেলো।বিভান উঠে ল্যাপটপ নিয়ে এসে সেই একই নম্বরে কল দিলো।বেলা বিভানের পাশে এসে বসে।রিং হচ্ছে।বেলার কান্না পাচ্ছে। একমাস পর মানুষ গুলো কে দেখবে ও।ওর নিজের মানুষ গুলো কে।এদিকে সাঁঝ গিয়ে জুলেখা বানুকে ডাকতে লাগলো।আপুকে কল করছিলো কিন্তু রিসিভ হচ্ছিলো না।আম্মা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।এখন কল এসেছে ওদের বহুল প্রতীক্ষিত কল।রুমে অনেক আগ থেকেই সবাই উপস্থিত।শুধু মাত্র আব্বা ছাড়া।আব্বা জানলে ও সমস্যা আছে।আম্মাকে যখন ডাকছিলো সাঁঝ পাশ থেকে ইকরাম রহমান বললেন,
''একটু আগে শুইলো সমস্যা কি?"
''আব্বা কাজ আছে।আম্মারে লাগবে।"
''পরে এখন না।যা তুই।"
''আব্বা আপনি বুঝবেননা মারে লাগবে।"
শেষমেষ ঘুম ভাঙ্গলো জুলেখা বানুর।মেয়ের দিকে রাগান্বিত চোখে চেয়েছিলেন ইকরাম রহমান কিন্তু কিছু বলেননি।ওরা আদনানের বন্ধু মীজান থেকে ল্যাপটপ ধার এনেছে মডেম সহ।ঘন্টায় একশত টাকা। মা কে নিয়ে রুমে ঢুকতেই কুঞ্জন লাবনীর পিঠে গুতো দিয়ে বলল,
''যা দরজা আটকা।"
''যাবো আরকি?এজন্য এভাবে পিঠে মারতে হয়?বড় ভাইয়া কিছু বলো না ওকে?"
নিশাদ চোখ রাঙ্গাতেই কুঞ্জন নিচে তাকায়।লাবনী দরজা আটকে সাঁঝ আর হুমায়রার মাঝে এসে বসে। আদনান কল রিসিভ করতেই বেলার চেহারা সবার সামনে ভেসে উঠে।বেলা কি বলবে তাই জানে না।গুঁমড়ে কেঁদে উঠে বলল,
''আম্মা!!!"
জুলেখা বানু ও কাঁদতে শুরু করলো মেয়েকে দেখে,
''আমার বেলা কই গেলি তুই?কোন দুরসাগরে গেলি আম্মারে!!!বুকটা ফাঁটে যখনই তোর কথা মনে পড়ে!!!"
লাবনী রীতিমতো হাসতে শুরু করেছে সাথে কুঞ্জন ও।বেচারা বিভান ও লুকিয়ে থাকতে পারেনা।তেমন একটা বুঝতে পারেনা ওদের কথা তারপর যা শুনলো হাসি পাচ্ছে।তারপর ও হাসা যাবে না কারন ওর বেলারানী কাঁদছে।খাটে এসে বসে বিভান।সাথে সাথে সাঁঝ হুমায়রা কাপড় ঠিক করে সালাম দেয় বিভানকে।বিভান সালামের উত্তর দিয়ে বেলাকে স্বাভাবিক করতে থাকে।এদিকে সাঁঝ আর হুমায়রাও মাকে স্বাভাবিক করে।বেলার কান্না থেমেছে তারপর ও চোখ জোড়া টলটল করছে।বেলা সবাইকে দেখে নিচ্ছে।নিশাদ বলল,
''আপা কেমন আছিস?"
''তোদের দেখে ভালো লাগছে।তোরা কেমন আছিস?"
''ভালো।ভাই ভালো আছেন?"
''হুম।তোমাদের দেখে ভালো লাগছে।আসসালামু আলাইকুম মা।ভালো আছেন?"
জুলেখা বানু কান্না জড়িত চোখে বলল,
''ভালো। তুমি কেমন আছো আব্বা?"
বেলা বিভানকে বলল,
''মা ভালো আছে।আপনি কেমন আছেন সেটা জানতে চাইলো?"
''জি মা ভালো।"
লাবনী এসে বলল,
''আপা ভালো আছিস?"
''হ্যা পুচকি তোর কি খবর?"
''এই তো আলহামদুলিল্লাহ। "
বিভান বলল,
''লাবনী বড় হয়ে গেছো অনেক।"
''আপনি ও তো বুড়ো হয়ে গেছেন।"
বিভান হেসে বলল,
''ঠিক বলেছো একদম।"
আদনান বলল,
''সবাই কেমন আছে বাসার?"
বেলা হেসে বলল,
''ভালো আছে।ঈদ কেমন গেলো?"
নিশাদ বলল,
''ভালো আপা।"
বেলা বিভানকে বলল,
''একটু পানি আনবেন প্লিজ?"
বিভান নিচে গেলো পানি আনতে। বেলা বলল,
''গত দুমাসের টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলি।সব ঠিক আছে তো?"
নিশাদ বলল,
''আপা জবের আগে টাকা দিয়েছিলি।এখন তো জব হয়ে গেছে।তাই পাঠিয়ে দিয়েছি।"
''এগুলো আমি পাঠিয়েছিলাম।অনলাইন বিজনেসে কিছু টাকা আয় করেছিলাম সেগুলো।বিভান জানেননা বিজনেসের কথা।"
''এতো ঝামেলা করে পাঠাতে হবেনা।আমি করছি তো সব।"
''কেন আমার টাকা নিলে কি ছোট হয়ে যাবি তোরা?"
কিছুটা রেগে গেলো বেলা।নিশাদ চুপ হয়ে গেলো।কারোর সাহায্যে থাকতে চায়না ও।বেলা ওর বড় বোন কিন্তু সে ও তো পরের ঘর করে।অবশ্যই কষ্ট করে টাকা গুলো আয় করেছিলো।বিভান পানি নিয়ে ফিরে এলো।ওদের কথার টপিক পাল্টে গেলো।অনেকটা সময় পর্যন্ত কথা হলো সবার।কথা শেষে আদনান দেড়শ টাকা সহ ল্যাপটপ নিয়ে বেরিয়ে গেলো বন্ধুকে দেয়ার জন্য।নিশাদ উঠে রুমে চলে এলো।বোন বেলার সাথে ওর সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক এমনকি ওর নির্ভরতার জায়গা ছিলো বেলা এখন ও আছে।তবে আগের মতো কথা হয়না ওদের। কারন বাবা এখন বিভান ভাইকে জামাই হিসেবে মেনে নিতে পারেননি।বাবার অমতে বিয়েটা হয়েছিলো বেলার।নিজেও তো সেদিন বেলার বিপক্ষে চলে গিয়েছিলো।বেলা কে ঘর ছাড়তে হয়েছিলো অপমানিত হয়ে।নিশাদের মনে পড়ে যায় পনের বছর আগের কথা।ওদের একটা সুন্দর সময়ের কথা যখন ওর সবাই একসাথে ছিলো ভালো ছিলো।বেলা চোখ মুছে সরে যায়।কাপড় পাল্টে খাটে এসে বসে।বিভান বলল,
''ঠিক আছো?"
''হুম।বিভান আমার কি অধিকার নেই ওদের সাহায্য করার?"
''অবশ্যই আছে।ওনাদের মেয়ে বড় বোন তুমি।আগে কেন বলোনি?"
''লজ্জা!!লজ্জায় আপনাকে বলতে পারিনি।"
''বেলা তুমি যেমন এই বাসার বৌ আমি ও জামাই ঐ বাসার।আমার ও দায়িত্ব আছে তাদের প্রতি।ওনাদের রাগ ক্ষোভ জায়েজ।যা করেছিলাম সেটা কোন সমাজ মেনে নিতে পারবেনা সহজে।"
''পরিস্থিতিটা কেমন ছিলো।সেটা তো আপনার ধারনায় আছে।"
''হুম তবে সামলে নিতে পারতাম অন্যভাবে।"
বেলা উঠে বলল,
''এখন এসব বলবেননা।আমার ভালো লাগছেনা।"
বিভান চুপ হয়ে যায়।বেলা পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে।চোখে ভেসে উঠে ওর সেই জীবনটার কথা।যখন মুক্ত বিহঙ্গের মতোই ছিলো,,,,,,,,
চলবে