এই রাত তোমার আমার
ওই চাঁদ তোমার আমার, শুধু দুজনের |
এই রাত শুধু যে গানের
এই ক্ষণও এ দুটি প্রাণের কুহু কুজনের |
এই রাত তোমার আমার।।
তুমি আছো আমি আছি তাই,
অনুভবে তোমারে যে পাই, শুধু দুজনের |
এই রাত তোমার আমার ||
..................
বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত বেলা। সারাদিনের কাজ সেড়ে রুমে এলো ও।লোকটা এখনো আসেনি।সে কই আছে কে জানে?অবশ্য কাজে থাকলে কল ধরেনা সে।তবে বেলা জানে দিন শেষে তো লোকটা তার কাছে ফিরে আসবে। বড্ড ভালবাসে যে তাকে।হঠাৎ গান শুনে চমকে উঠে বেলা।বারান্দা থেকে বেরিয়ে আসে না।লোকটা অপেক্ষা করায় সে ও করাবে।মুচকি হেসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে বেলা।হঠাৎ দরজা আটকানোর শব্দ পেলো ও।পর্দা দিয়ে রুমে উঁকি মেরে দেখলো আলো বন্ধ রুমের।শাড়ীর আঁচল টাকে অপর কাঁধ থেকে ফেলে শুধু এক কাঁধে জড়িয়ে নিয়েছে।বৃষ্টি হচ্ছিলো। বেশ ভালো লাগছিলো।তবে দিল্লিতে বৃষ্টি হলে খুব শীত লাগে বেলার।ব্যাপারটা ওর সাথেই ঘটে আর কারোর সাথেইনা।বহিরাগত বলে কথা!!!নিচ থেকে বিভানের কথা শুনতে পেলো ও।
ঘরে এসে স্ত্রীকে রুমে না পেয়ে নিচে চলে যায় বিভান শেখ।ছেলেকে এমন অস্থির হতে দেখে বন্দনা আখতার ছেলের কাছে এগিয়ে আসেন।ঘরের দরজা জানালা আটকে রুমে আসছিলেন ওনি।তারপর ছেলেকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন।বিভান মাকে দেখে কিছু টা চমকে উঠে বলল,
''মা তুমি ঘুমাও নি?"
''কেমনে ঘুমাবো বল?তুই আসবি।খেয়েছিস কিনা সেটাও বলতে পারবোনা।"
'মা বেলা থাকতে এতো টেনশন করো কেন?"
''বেলা কি করবে বল?সারাদিন ফোন নিয়ে পড়ে থাকে।ছাদে গিয়ে ফোনে কথা বলে জানিস?কেমনে থাকিস এই মেয়ের সাথে?"
একটু হেসে মাকে জড়িয়ে ধরে বিভান।তারপর বলল,
''মা তেমন কিছুনা।যাও ঘুমাও।"
''তোর চোখে লাগবেইনা তোর বৌয়ের দোষ।যাই হোক কি খুঁজছিলি?"
''কিছুনা মা।গিয়ে ঘুমাও তুমি।"
এদিকে নিচে শাশুড়ীর কথা শুনে ভীষন খারাপ লাগে বেলার।এতোটা বছর পার হয়ে গেছে ওকে দেখতে পারেনা বন্দনা আখতার।চোখে অশ্রু আসতে চাইলে ও ঠোঁট কামড়ে সেটাকে দমিয়ে রাখে।খাটে বসে নখ কাঁটতে শুরু করে।এরই মাঝে রুমে বিভানের আগমন।স্ত্রীকে দেখে স্বাভাবিক সুরে বলল,
''কই ছিলে?"
''বারান্দায় ছিলাম।সেটা খেয়াল করেননি আপনি?"
''রুম অন্ধকার ছিলো তাই হয়ত।"
''হুম।"
বিভান খাটে এসে বসে বেলার পাশ ঘেঁষে।তারপর ওর কাঁধে নাক বুলিয়ে বলল,
''গানটা কেমন হচ্ছিলো?"
''বেশ ভালো।খেয়েছেন?"
''হুম।তুমি?"
''খেয়েছিলাম বিকেলে।এখন খিদে নেই।"
রেগে গেলো বিভান। উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল,
''এটা কেমন কথা বেলা?তুমি জানো তোমার শরীর ভালো নেই।কেন করছো এমন?কোন জাতের নাটক করো প্রত্যেকদিন? "
বেলা ভয় পেয়ে গেলো।নিচে কেউ শুনলে বিপদ হবে।তাই মিনতির স্বরে বলল,
''প্লিজ একটু আস্তে কথা বলুন।সবাই কি ভাববে?"
''সবার ভাবার এতো ভাবনা থাকলে খাওনা কেন?"
আগের রাগী স্বরেই বলল বিভান।বেলা কেঁদে দিলো।তারপর বলল,
''প্লিজ চিৎকার করবেননা।আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।এক্ষুনি খেয়ে নিবো।এমন করবেননা।"
বিভান স্বর কমিয়ে আনে তারপর ও গলায় রাগের আভাস রেখেই বলল,
''কতোদিন মানা করেছি অপেক্ষা করতে না আমার।কিন্তু কোন কথাই তো শুনোনা।যাও খেয়ে নাও।"
বেলা নিচে নেমে আসে।পাকঘরে এসে প্লেটে খাবার বেড়ে নিতেই হাতের মাঝে গরম পাতিল লাগতে প্রচন্ড ভাবে জ্বলে উঠে হাত।চিৎকার করতে গিয়ে ও স্বর আটকে আসে।হাতের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে দেখতে পায় কুনুইয়ের ওপর থেকে পোড়া দাগ।সেটা একদম নতুন।প্লেট রেখে হাতে মলম লাগিয়ে নেয় ও।তারপর খেতে শুরু করে।অপরদিকে সেদিন অফিস টাইম শেষে হাঁটতে শুরু করে নিশাদ।হাতে একটা টাকা ও নেই বললেই চলে।অনেকটা পথ পাড়ি দেয়ার পর পাশের একটা বেঞ্চে বসে পড়ে ও।তারপর একটা সিগারেট বের করে ফুঁক দিতে শুরু করে।সেটার ধোয়া গুলো বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে।হঠাৎ তখন আদনান নিশাদ কে দেখে কিছুটা অবাক হয়।এসময়ে এখানে কেন? গাড়িতে থাকার কথা ছিলো।বন্ধুর ছেলের জন্মদিনের দাওয়াত খেয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো কোন টঙ্গে।নিশাদ কে দেখে বন্ধুদের অপেক্ষা করতে বলে ভাইয়ের কাছে ছুটে আসে আদনান।নিশাদ সিগারেটে ফুঁক দেয়ার মাঝে ভাইকে দেখতে পেয়ে একটু হাসে।আদনান এসে ওর পাশে বসে বলল,
''ভাই বাসায় যাসনি?"
''উহুম।তুই কি করিস? তোর না দাওয়াত ছিলো?"
''হ্যা ওখান থেকে ফিরলাম।তা এখানে বসে আছিস যে?"
''এমনি।তুই যা আড্ডা দে।"
''ওয়েট আমি আসছি।"
আদনান বন্ধুদের কাছে চলে গেলো।ওদের বিদায় জানিয়ে একটা সিএনজি ঠিক করে।তারপর নিশাদকে এসে বলল,
''চল বাসায় যাই।রাত কম হলোনা।"
''হুম।"
নিশাদ ভাইয়ের সাথে সিএনজিতে উঠে যায়।সিএনজি চলতে শুরু করে।আদনান কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল,
''কয়েক জায়গায় ইন্টারভিউ দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু কেউ ডাকছেনা।"
ভাইয়ের দিকে তাকায় নিশাদ।তারপর গম্ভীর আওয়াজে বলল,
''ভালোমতো খবর নিয়েছিস?"
''হ্যা ভাই।ওরা প্রথমে জানিয়েছিলো অগ্রিম দুলাখ দেয়া লাগবে।"
''দুই লাখ!!জানোয়ারের বাচ্চারা ডাকাতি করছে দেখি।"
রেগে কটমটে গলায় বলে নিশাদ।আদনান বলল,
''ভাই আমি আরো খুঁজবো।তুই চিন্তা করিসনা প্লিজ।"
''হুম।"
দুজনে চুপ হয়ে গেলো।নিশাদ জিজ্ঞেস করলো,
''কুঞ্জনের খবর জানিস কিছু?ঘরে ফেরে কখন কিছুই তো টের পাইনা।"
আদনান বলল,
''আমাকে বলছিলো লাবনীকে নিয়ে চাচ্চুর বাসায় যাবে।আমি বললাম তোকে বলতে।ও বলে তোর সাথে ফেস করতে পারবেনা তাই যেন আমি বলে দেই?"
''ফেস কেন করতে পারবেনা?"
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে নিশাদ।আদনান হেসে বলল,
''ভয় পাওয়ার যতো এক্টিং করুকনা কেন ও কখনো সত্যিকারের ভয় পায়না। বন্ধুদের সামনে বীর পুরুষ সাজে।"
নিশাদ একটু হেসে বলল,
''আর মানুষ পেলোনা ঘুরতে যাওয়ার জন্য?চাচ্চুর বাসা সিরিয়াসলি?"
''ভাই লাবনী জেদ করছিলো বাহিরে যাওয়ার জন্য।সাঁঝ কলেজে ছিলো,হুমায়রা ও তো কলেজে ছিলো।তাই ওদের বলেছি কিছুক্ষনের জন্য গিয়ে ঘুরে আসতে।"
''হুম।"
ঘরে ফিরে দেখলো মা ভাতের প্লেট সাজাচ্ছে টেবিলে।নিশাদ কে দেখে বলল,
''তোর আব্বার প্রেশার লো হয়ে গেছে।তোরে কতো বার কল করছি কই ছিলি?"
নিশাদ ফোন বের করে দেখলো সুইচ অফ।তারপর বলল,
''আম্মা ফোনের ব্যাটারি শেষ।কই আব্বা?"
''রুমে যায়া দেখ।"
নিশাদ আর আদনান দৌড়ে রুমে আসে।সাঁঝ মাথায় পানি ঢালছে হুমায়রা পা টিপছে আর লাবনী কাছে বসে কুরআন শরীফ পড়ছে।নিশাদ কে দেখে সাঁঝ সরে এলো।নিশাদ বাবার মাথার কাছে বসে বলল,
''আব্বা কিছু হবেনা আপনার।সাঁঝ ডাক্তার ডেকেছিলি?"
সাঁঝ বলল,
''জি ভাইয়া।ডাক্তার ঔষধ দিয়ে গেলো।"
আদনান বলল,
''তোরা বের হ রুম থেকে।লাবনী তুই কুরআন শরীফ পড়ে বের হবি।"
লাবনী মাথা ঝাঁকিয়ে সুরা ইয়াসীন পড়তে থাকে।জুলেখা বানু টেবিলে খাবার সাজিয়ে ছেলে মেয়েদের ডাকতে শুরু করেন তবে আগে একটা নাম মুখে আসতেই চুপ হয়ে যান।ভেতরটা কেমন কেঁপে উঠে ওনার।তখনই কুঞ্জন ভিতরে এলো মেডিসিন নিয়ে।এসেই টেবিলের ওপর ঔষধ রেখে বলল,
''আব্বার কি খবর আম্মা?"
''অজ্ঞান হয়ে আছে।কিছু কয়না।"
''টেনশন কইরোনা তো কিছু হইবোনা।ভাইয়ারা আসছে?"
''হুম।তুই যা ফ্রেশ হয়ে আয়।সব গুলা একসাথে বইসা খাইস।তোগরে একসাথে দেখলে পরানডা জুড়ায়া যায়।"
কুঞ্জন হেসে বলল,
''আম্মা তোমার পরান জুড়াইতে জুড়াইতে কখন যে ফাঁইটা যায় আমি ভেবে অস্থির।"
পিছন থেকে জুলেখা বানু রেগে বললেন,
''জানোয়ার বাপ হইলে বুঝবি পোলাপাইনের লাইগা কেমন লাগে?"
কুঞ্জন কিছু না বলে রুমে চলে গেলো।কিছুক্ষন পর সবাই খেতে বসে।টেবিলের চেয়ার চারটা।তাই টেবিলে বসলো নিশাদ মা আদনান আর লাবনী।আর সোফায় বসেছে সাঁঝ হুমায়রা আর কুঞ্জন খাটের ওপর দুপা তুলে খাচ্ছে।খাওয়ার মাঝে সাঁঝ লাবনীকে জিজ্ঞেস করলো,
''চাচী কি খাইয়েছে?"
''চা আর বিস্কিট দিছে।চা টা পুরো পানি পানি। কেমন গন্ধ ছিলো।"
ছোট বোনের মুখে কথা শুনে কষ্ট লাগে নিশাদের।রুম থেকে কুঞ্জন রসিকতা করে বলল,
''আর যেন না যাস সেজন্যই এমন করেছে।"
লাবনী ক্ষোভ নিয়ে বলল,
''কসম কাঁটলাম আর যাবোনা।আপু আর ভাইয়া কেমন করছিলো কথাই বলেনি।"
নিশাদ রেগে বলল,
''ওদের সম্বন্ধে ভালো করেই জানিস।তারপর ও কেন গেলি অপমান হতে?"
লাবনীর মুখ চুপসে গেলো ভয়ে।তারপর মলিন কন্ঠে বলল,
''কুরবানীর পরে কোথাও যাইনি তাই গিয়েছিলাম ঘুরতে।সরি ভাইয়া আর যাবোনা।"
জুলেখা বানু উঠে এসে লাবনীর দিকে ধমকের স্বরে বললেন,
''ওরা কুরবানী দিয়েছে জানিস?কিন্তু বড় ভাইয়ের বাসায় এক টুকরা মাংস ও পাঠাইলোনা।হেরা কি জানেনা তোদের আব্বা কুরবানী দিতে ফারেনা।অমানুষ কেমন দেখলি।তুই মাইয়া কথাই হুনোস না।কতোবার কইলাম না যাইতে।কিন্তু তুই তেড়া জানোয়ার যাবিই।"
নিশাদ জিজ্ঞেস করে,
''কেমনে জানলা আম্মা?"
''হুন আব্বা হাছা কথা লুকাইয়া থাকেনা।পাঁচ লাখ দিয়া গরু কিনছে।চিন্তা কর কতো বড় খাসি ওয়ালা গরু।"
নিশাদ বলল,
''আম্মা এসব বইলোনা।সামনের বছর আমরাও দিবো।"
চলবে